সুখ কোথায় থাকে?

       সুখ কোথায় থাকে? এই অংশে উত্তর চিন্তা করিয়া অনেকে বলিতে পারেন যে, যখন সুরম্য হর্ম্মে বাস করিয়া ,দুগ্ধফেননিভ শয়নে শয়ান হ‌ইয়া সুখলাভ হয়, যখন উৎকৃষ্ট খাদ্যদ্রব্য ভোজন করিয়া সুখলাভ হ‌ইয়া থাকে, যখন সুললিত মনোহর বাদ্য কিংবা কোকিল -কাকলী সুখ প্রদান করে, যখন সুখস্পর্শ দ্রব্য স্পর্শ করিয়া,সুদৃশ্য পদার্থ দর্শন করিয়া, মনে আনন্দ জন্মে এবং যখন সৌরভপূর্ণ সুশীতল সুদৃশ্য উপবনে  আসীন 



  হ‌ইলে, সুখলাভ করা যায়, তখন অবশ্যই ঐ সকল ও এরূপ অন্যান্য পদার্থে সুখ বিদ্যমান আছে, স্বীকার করিতে হ‌ইবে। কিন্তু বাস্তবিক তাহা নহে। কারণ, বাস্তবিক তাহা নহে।কারণ, বাহ্যবস্তুতে সুখ আছে, ইহা স্বীকার করিলে অনেক সময়ে তাহার ব্যভিচার দৃষ্ট হ‌ইবে কেন ? দেখুন,যে সুধাধবল প্রাসাদশ্রেণী এক সময়ে এক অবস্থায় সুখাবহ হয়,তাহাই আবার অবস্থা বিশেষে অসুখের আকর হ‌ইয়া থাকে।কারণ, 



 ঐ অট্টালিকা কোন‌ও মৃত স্নেহাস্পদের বাসস্থান হ‌ইলে, কিংবা স্বীয় জীবনের কোন ও কষ্টকর - পাপকর কার্য্য সাধনের স্থান হ‌ইলেই ঐরূপ হ‌ইতে পারে। আবার,যে সুকোমল সুশীতল সুপরিষ্কৃত শয্যায় প্রগাঢ় প্রীতির আদর্শ স্বরূপা প্রিয়তমার সহিত একত্র শয়নে সুখরাশি সম্ভোগ হ‌ইয়া থাকে,জীবনানন্দদায়িনী ঐ রমণীর অভাবে তাহাই আবার কণ্টকময়ী বোধ হয়। 


সে সুরস খাদ্য সুস্থাবস্থায় ভোগ-প্রবৃত্তি বদ্ধিত করে ও সুখকর হয়,তাহাই আবার  কণ্টকময়ী বোধ হয়। যে সুরস খাদ্য সুস্থাবস্থায় ভোগ -প্রবৃত্তি বদ্ধিত করে ও সুখকর হয়,তাহাই আবার অসুস্থাবস্থায় কষ্টদায়ক হয় বলিয়া রসনা স্পর্শমাত্রে পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হ‌ইতে হয়। এইরূপে সর্ব্ববিষয়েই দেখা যায় যে,বাহ্যবস্তুতে সুখ নাই।তবে এখন জিজ্ঞাস্য এই যে, যদি বাহ্য বস্তুতে সুখ না রহিল , তবে সুখ কোথায় আছে? 


  ইহার উত্তরে এইমাত্র বলা যায় যে,সুখ যাহার গুণ,সুখ তাহাতেই থাকে, অর্থাৎ চৈতন্যবান্ বিনা অচেতন কখনও সুখী হ‌ইতে পারে না, সুতরাং সুখ চৈতন্য বানেই থাকে। এই সিদ্ধান্তে প্রথম আপত্তি এই হ‌ইতে পারে যে, যদি চৈতন্যবানেই সুখ থাকে, তবে মনুষ্যমাত্রেই তো চৈতন্যবান, তবে তাহারা সকলে কেন সুখী নহে? ইহার উত্তর এই যে, মনুষ্য মাত্রেই চৈতন্যবান হ‌ইলেও,  তাহারা সাধারণতঃ জড়ের সহিত - জড়ভাবের সহিত এতদূর সম্বন্ধ যে, 



 আপনাদিগকেও অনেক সময়ে জড় বলিয়া ভাবে, এবং তজ্জন্য তাহাদিগের দেহে আত্মবুদ্ধি -ভ্রম সাধারণতঃ বিদ্যমান আছে। যতদিন পর্য্যন্ত এই ভ্রান্তিময়ী মায়া তাহাদিগকে পরিত্যাগ না করে, যতদিন পর্য্যন্ত তাহারা জড়ত্ব হ‌ইতে আপনাদিগকে নির্ম্মুক্ত করিতে না পারে এবং যতদিন পর্য্যন্ত তাহাদিগের এই ভাব কিঞ্চিৎ পরিমাণেও হৃদয়ে অবস্থিতি করে, 



  ততদিন পর্য্যন্ত তাহারা সম্পূর্ণ সুখী হ‌ইতে পারে না এবং ততদিন পর্য্যন্ত‌ই তাহাদিগের জড়পদার্থবলম্বনে সুখ -সঞ্চার অবশ্যম্ভাবী। এইরূপ জড়াবস্থায় জড়পদার্থ বিশেষ অবলম্বনে তাহাদিগের আন্তরিক জড়তার যে বিনাশ বিশেষ অবলম্বনে তাহাদিগের আন্তরিক জড়তার যে বিনাশ -বিশেষ সংঘটিত হয়, তাহাতেই তাহারা সুখী হ‌ইয়া থাকে। যিনি কখনও 



  ব্রক্ষ্মানন্দ লাভ করিয়াছেন, তিনি অবশ্য‌ই বলিবেন যে,জড়পদার্থের আশ্রয় ব্যতীত ও সুখ আছে। পক্ষান্তরে ,জড় পদার্থে সুখ নাই,প্রতিপন্ন হ‌ইল।অত‌এব ইহা নিশ্চয়‌ই যে চৈতন্যৈই সুখ অবস্থিতি করে। পরন্তু মনুষ্য যে পর্য্যন্ত যে পরিমাণে জড়ত্বে বন্ধ থাকে, সেই পর্য্যন্ত সেই পরিমাণে জড়ের সংসর্গ না থাকিলে সে সুখী হ‌ইতে পারে না। অত‌এব জড়ভাব -সমন্বিত চৈতন্যাংশের সুখ-লাভ,জড়পদার্থ অবলম্বনে হয়, কিন্তু জড়ে কখনও সুখ থাকে না। 



 অর্থাৎ বাহ্যবস্তু অবস্থাবিশেষে চৈতন্যাংশের ইচ্ছার অনুরূপ হ‌ইলে, তাহাতে সুখের স্ফূর্তি হয় মাত্র, নতুবা উহাতে সুখের সত্তা নাই।সুখ চৈতন্য বান্ আত্মার গুণ বলিয়া আত্মাই উহার আধার।
                                 — ঈশ্বর গুরুনাথ সেনগুপ্ত।

————————————————————
                        চলিত ভাষায়


       সুখ কোথায় থাকে? এই অংশের উত্তর চিন্তা করে অনেকে বলতে পারেন যে, যখন মনোহর অট্টালিকায় বাস করি দুধের ফেনায় নিমগ্ন হয়ে শুয়ে সুখ লাভ হয়ে থাকে, যখন উৎকৃষ্ট খাদ্যদ্রব্য খেয়ে সুখ লাভ হয়ে থাকে, যখন কোমল সুরে মনোহর বাজনা কিংবা কোকিল-কাকুলী সুখ প্রদান করে, যখন সুখের ছোয়ায় দ্রব্য স্পর্শ করি, যে পদার্থ সুন্দর দেখতে, তা দেখে মনে আনন্দ জন্মায় এবং যখন সুন্দর গন্ধপূর্ণ সুশীতল সুন্দর দেখতে উপবনে বসলে সুখলাভ করা 



  যায়, তখন অবশ্যই ঐসকল ও ঐরূপ অন্যান্য পদার্থে সুখ বিদ্যমান আছে, স্বীকার করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। কারণ, পার্থিব  বস্তুতে সুখ আছে, এটা স্বীকার করলে অনেক সময়ে তার অনিষ্ট দেখতে হবে কেন? দেখুন, যে অমৃত সাদা প্রসাদ শ্রেণী এক সময় এক অবস্থায় সুখ প্রবাহ হয়, তাই আবার অবস্থা বিষয়ে অসুখের বাসা হয়ে থাকে। কারণ, ঐ অট্টালিকা কোন মৃত স্নেহাস্পদের  বাসস্থান হলে, কিংবা নিজের জীবনের কোন এক কষ্টকর— পাপকর 



 কাজ লাভের স্থান হলে ঐরূপ হতে পারে। আবার, যে সুন্দর নরম সুন্দর ঠান্ডা সুন্দর পরিষ্কার বিছানায় প্রগাঢ় প্রেমের আদর্শ অপরুপা প্রিয়তমার সঙ্গে একত্রিত শুয়ে সুখ রাশি ভোগ হয়ে থাকে, জীবনে আনন্দ প্রদানকারী ঐ রমণীর অভাবে তার আবার কন্টকময়ী বোধ হয়। যে সুন্দর রস যুক্ত খাদ্য সুস্থ অবস্থায় ভোগ করতে ইচ্ছা করে ও সুখকর হয়, তাই আবার অসুস্থ অবস্থায় কষ্টদায়ক হয় বলে রসনায় ছোঁয়া মাত্র পরিত্যাগ করতে বাধ্য হতে হয়। 



 এইরূপ সব বিষয়েই দেখা যায় যে পার্থিব বস্তুতে সুখ নাই। তবে এখন জিজ্ঞাসা এই যে যদি পার্থিব বস্তুতে সুখ না থাকে, তবে সুখ কোথায় আছে? এর উত্তরে এইমাত্র বলা যায় যে, সুখ যার গুন, সুখ তাতেই থাকে, অর্থাৎ চেতনা বিনা অচেতন কখনো সুখী হতে পারে না, সুতরাং সুখ চেতনাবানেই থাকে। এই সিদ্ধান্তে প্রথম আপত্তি এই হতে পারে যে যদি চেতনাই সুখ থাকে তবে মানুষ মাত্রই তো  চেতনা বান, তবে তারা সকলে কেন সুখী নয়? এর উত্তর এই যে, মানুষ মাত্রই 



  চেতনা বান হলেও তারা সাধারণত জড় পদার্থের সঙ্গে জড় ভাবের সঙ্গে এক‌ই রকম সম্বন্ধ যে নিজেদের কেও অনেক সময়ই জড় বলে ভাবে, এবং তার জন্য তাদের দেহে নিজের বুদ্ধির ভুল সাধারণত বিদ্যমান আছে ‌। যতদিন পর্যন্ত এই ভুলময়ী মায়া তারা ত্যাগ না করে, যতদিন পর্যন্ত তারা জড়ো হতেও নিজেদের কে পূর্ণ ভাবে মুক্ত করতে করতে না পারে এবং যতদিন পর্য্যন্ত তাদের এই ভাব কিঞ্চিৎ পরিমাণেও হৃদয়ে অবস্থান করে, ততদিন পর্যন্ত তারা 



  সম্পূর্ণ সুখী হতে পারে না এবং ততদিন পর্য্যন্ত‌ই তাদের জড় পদার্থ অবলম্বনে সুখ সঞ্চার অবশ্যই সম্ভব। এইরূপ জড় অবস্থায় জড়পদার্থ বিশেষ অবলম্বনে তাদের নিজের জড়তার যে বিনাশ বিষয়ে সংঘটিত হয়, তাতেই তারা সুখী হয়ে থাকে। যিনি কখনো পরমপিতার দর্শন আনন্দ লাভ করেছেন, তিনি অবশ্যই বলবেন যে জড় পদার্থের আশ্রয় ছাড়াও সুখ আছে। পরিপেক্ষিতে, জড় পদার্থে সুখ নাই প্রতিপন্ন হলো। অতএব এটা নিশ্চয়ই যে চেতনাই সুখ অবস্থান 



  করে। সুতরাং মানুষ যে পর্য্যন্ত যে পরিমাণে জড় পদার্থে আবদ্ধ থাকে, সেই পর্য্যন্ত সেই পরিমাণে জড়ের সম্পর্ক না থাকলে সে সুখী হতে পারে না। অতএব জড় ভাব একত্রিত চেতনা অংশের সুখলাভ, জড়পদার্থ অবলম্বনেই হয়, কিন্তু জড়ে কখনও সুখ থাকেনা। অর্থাৎ পার্থিববস্তুর অবস্থা বিশেষে চেতনা অংশের ইচ্ছার অনুরূপ হলে তাতেই সুখের আনন্দ হয় মাত্র, নতুবা ওখানে সুখের সত্তা নাই। সুখ চেতনা বান আত্মার গুন বোলে আত্মাই  উহার খাদ্য।