নর- সৃষ্টি
অনন্ত শক্তিসম্পন্ন পরমপুরুষের ইচ্ছায় পূর্বোক্ত নরমিথুনের উৎপত্তি হইলে, তাহাদের মৈথুনধর্ম্মে বহু সংখ্যক নর নারী উৎপন্ন হইল। বাইবেলে কথিত আছে যে অদ্য নরের নাম আদম (আদিম) এবং আদ্যা নারীর নাম ইভ বা হবা। এই উভয় নামই গুনানুসারী, কেননা তখনও বহুসংখ্যক নরের উৎপত্তি না হওয়াতে নামের প্রয়োজন ও প্রচলন ছিল না।
আদিতে উৎপন্ন বলিয়া আদিম এবং প্রথম উৎপত্তিসাধন হোমক্রিয়া (রমনক্রিয়া) যাহাতে কৃত হইয়াছিল সেই নারী 'হবা' বলিয়া বিখ্যাত। ( হূয়তে রমন-ধর্ম্মণ হোমক্রিয়া সম্পাদ্যতে অস্যামিতি হবা। জুহোতেরধিকরণে অল্, স্ত্রিয়ামাপ্ চ।) অস্মদ্দেশীয় মনুসংহিতায় লিখিত আছে যে, ব্রহ্মা আত্মদেহ দ্বিধা করিয়া অর্দ্ধ অংশ দ্বারা পুরুষ ও অপর অদ্ধ দ্বারা নারী হইলেন।
সেই নরনারীর মৈথুন ক্রিয়ায় 'বিরাট' পুরুষ নির্ম্মিত হইলেন। ( দ্বিধাকৃত্বাত্মানো দেহ মর্দ্ধেন পুরুষোঽভবৎ। অর্দ্ধেনানরী, তস্যাৎ স বিরাজ মসৃজৎ প্রভুঃ ।। তপস্তপ্তাঽসৃজদ্ যন্তু স স্বয়ং পুরুষো বিরাট্। তং মাং বিত্তাস্য সর্ব্বস্য স্রষ্টারং দ্বিজসত্তমাঃ।। - মনু।১মঃ। ৩২ শ্লোক) সেই বিরাট পুরুষ হইতে মনুর উৎপত্তি।
যাহা হউক পৃথিবীস্থ প্রচলিত যাবতীয় ধর্ম্মগ্রন্থেই প্রথমে একটি নর ও একটি নারীর উৎপত্তি বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু পারলৌকিক মহাত্মারা বলেন যে, পৃথিবীতে প্রথমে ষষ্ঠি-সংখ্যক নবদম্পতির উৎপত্তি হয়। ইহারা যে পৃথিবীর কোনও একস্থানেই উৎপন্ন হইয়াছিলেন, তাহা নহে।
আদিতে উৎপন্ন বলিয়া আদিম এবং প্রথম উৎপত্তিসাধন হোমক্রিয়া (রমনক্রিয়া) যাহাতে কৃত হইয়াছিল সেই নারী 'হবা' বলিয়া বিখ্যাত। ( হূয়তে রমন-ধর্ম্মণ হোমক্রিয়া সম্পাদ্যতে অস্যামিতি হবা। জুহোতেরধিকরণে অল্, স্ত্রিয়ামাপ্ চ।) অস্মদ্দেশীয় মনুসংহিতায় লিখিত আছে যে, ব্রহ্মা আত্মদেহ দ্বিধা করিয়া অর্দ্ধ অংশ দ্বারা পুরুষ ও অপর অদ্ধ দ্বারা নারী হইলেন।
সেই নরনারীর মৈথুন ক্রিয়ায় 'বিরাট' পুরুষ নির্ম্মিত হইলেন। ( দ্বিধাকৃত্বাত্মানো দেহ মর্দ্ধেন পুরুষোঽভবৎ। অর্দ্ধেনানরী, তস্যাৎ স বিরাজ মসৃজৎ প্রভুঃ ।। তপস্তপ্তাঽসৃজদ্ যন্তু স স্বয়ং পুরুষো বিরাট্। তং মাং বিত্তাস্য সর্ব্বস্য স্রষ্টারং দ্বিজসত্তমাঃ।। - মনু।১মঃ। ৩২ শ্লোক) সেই বিরাট পুরুষ হইতে মনুর উৎপত্তি।
যাহা হউক পৃথিবীস্থ প্রচলিত যাবতীয় ধর্ম্মগ্রন্থেই প্রথমে একটি নর ও একটি নারীর উৎপত্তি বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু পারলৌকিক মহাত্মারা বলেন যে, পৃথিবীতে প্রথমে ষষ্ঠি-সংখ্যক নবদম্পতির উৎপত্তি হয়। ইহারা যে পৃথিবীর কোনও একস্থানেই উৎপন্ন হইয়াছিলেন, তাহা নহে।
এই ষষ্টিসংখ্যক দম্পতির মধ্যে বহুস্থানেই একটি নর ও একটি নারী জন্মিয়াছিলেন। কেবল পৃথিবীর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ আসিয়া ( অদ্যাপি এশিয়া বলা হয়) ভাগে অর্থাৎ আস্য-খণ্ডে বহু দম্পতির উদ্ভব হয়। বোধহয়, এই জন্য ইহার নাম আসিয়া অর্থাৎ আস্য-খন্ড।
আস্য শব্দের অর্থ মুখ অর্থাৎ সর্ব্বপ্রধান অংশ বলিয়াই ইহার ঐ নাম হইয়াছিল ( আস্য বা আস্যা শব্দ অপভ্রষ্ট হইয়া 'আসিয়া' শব্দ উৎপন্ন হইয়াছে। আস্য শব্দ সম্বন্ধে যাহা বক্তব্য, তাহা মূলে লিখিত হইয়াছে। আস্যা শব্দের অর্থ আসন, ইহা জ্ঞানধর্ম্মাদির আসন বলিয়াও ঐ নাম হইতে পারে। অথবা 'অস্যা' শব্দের অর্থ মুখস্থিতা অর্থাৎ সর্ব্বাগ্রগণ্যা ভূমি, তজ্জন্যও ঐ নাম হইতে পারে। এই 'মুখস্থিতা' অর্থ, বিকৃত হইয়াই মুখ হইতে ব্রাহ্মণ ইত্যাদি পৌরাণিকী কল্পনার উদ্ভব হইয়াছে, বলিয়া বোধহয়।)
চিন্তাশীল পাঠক বিবেচনা করিয়া দেখিবেন যে, আসিয়ার ঐ নাম যে অন্বর্থ, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। কারণ, আসিয়া পৃথিবীর অন্যান্য ভাগ অপেক্ষা আয়তনে বৃহৎ। আসিয়া মানব জাতির উন্নতির আদিম ক্ষেত্র; আসিয়া সর্ব্বপ্রধান প্রাচীন গ্রন্থসমূহের ও বৃহত্তম পুস্তক-নিচয়ের রচনাক্ষেত্র; আসিয়া ব্যাকরণ, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, জ্যোতিষ, গণিত সঙ্গীতাদি সর্ব্বশাস্ত্রের উৎপত্তি ও উন্নতির স্থান;
আসিয়া ধর্ম্মসম্প্রদায় সমূহের উদ্ভব ভূমি; আসিয়া অদ্যাপি অধ্যাত্মতত্ত্বে সমস্ত সৃষ্টির সর্ব্বপ্রধান ক্ষেত্র এবং আসিয়া হইতেই জ্ঞানধর্ম্ম-ভানু সমুদিত ও স্বকীয় কিরণজালে জগৎ সমুজ্জল করিয়াছে। কি শাস্ত্র বিদ্যা, কি শস্ত্রবিদ্যা, কি অধ্যাত্ম-বিদ্যা— সর্ব্ববিষয়েই আসিয়াই সর্ব্বাগ্ৰগণ্য। যে ইউরোপ আজ জ্ঞানাভিমানে উন্মত্ত, তাঁহারাও যতই উন্নতি লাভ করিতেছেন, ততই আসিয়ার পূর্ব্বসঞ্চিত জ্ঞানের অনুসরণে বাধ্য হইতেছেন।
আস্য শব্দের অর্থ মুখ অর্থাৎ সর্ব্বপ্রধান অংশ বলিয়াই ইহার ঐ নাম হইয়াছিল ( আস্য বা আস্যা শব্দ অপভ্রষ্ট হইয়া 'আসিয়া' শব্দ উৎপন্ন হইয়াছে। আস্য শব্দ সম্বন্ধে যাহা বক্তব্য, তাহা মূলে লিখিত হইয়াছে। আস্যা শব্দের অর্থ আসন, ইহা জ্ঞানধর্ম্মাদির আসন বলিয়াও ঐ নাম হইতে পারে। অথবা 'অস্যা' শব্দের অর্থ মুখস্থিতা অর্থাৎ সর্ব্বাগ্রগণ্যা ভূমি, তজ্জন্যও ঐ নাম হইতে পারে। এই 'মুখস্থিতা' অর্থ, বিকৃত হইয়াই মুখ হইতে ব্রাহ্মণ ইত্যাদি পৌরাণিকী কল্পনার উদ্ভব হইয়াছে, বলিয়া বোধহয়।)
চিন্তাশীল পাঠক বিবেচনা করিয়া দেখিবেন যে, আসিয়ার ঐ নাম যে অন্বর্থ, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। কারণ, আসিয়া পৃথিবীর অন্যান্য ভাগ অপেক্ষা আয়তনে বৃহৎ। আসিয়া মানব জাতির উন্নতির আদিম ক্ষেত্র; আসিয়া সর্ব্বপ্রধান প্রাচীন গ্রন্থসমূহের ও বৃহত্তম পুস্তক-নিচয়ের রচনাক্ষেত্র; আসিয়া ব্যাকরণ, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, জ্যোতিষ, গণিত সঙ্গীতাদি সর্ব্বশাস্ত্রের উৎপত্তি ও উন্নতির স্থান;
আসিয়া ধর্ম্মসম্প্রদায় সমূহের উদ্ভব ভূমি; আসিয়া অদ্যাপি অধ্যাত্মতত্ত্বে সমস্ত সৃষ্টির সর্ব্বপ্রধান ক্ষেত্র এবং আসিয়া হইতেই জ্ঞানধর্ম্ম-ভানু সমুদিত ও স্বকীয় কিরণজালে জগৎ সমুজ্জল করিয়াছে। কি শাস্ত্র বিদ্যা, কি শস্ত্রবিদ্যা, কি অধ্যাত্ম-বিদ্যা— সর্ব্ববিষয়েই আসিয়াই সর্ব্বাগ্ৰগণ্য। যে ইউরোপ আজ জ্ঞানাভিমানে উন্মত্ত, তাঁহারাও যতই উন্নতি লাভ করিতেছেন, ততই আসিয়ার পূর্ব্বসঞ্চিত জ্ঞানের অনুসরণে বাধ্য হইতেছেন।
কি ইতর জিব, কি মানব, প্রথম সৃষ্ট সকলেই যে দ্রঢ়িষ্ঠ, বলিষ্ঠ ও অত্যায়ত-দেহসম্পন্ন ছিল, ইহা অনুমিত হয়। জলচর জন্তুর বর্ণনা সংস্কৃত গ্রন্থে যেরূপ দেখা যায়, তাহাতে বোধ হয় যে, ঐ সকল জীব কেবল মহাসাগরেই বিচরণ করিতে পারিত। যে সকল মহাকুর্ম্ম, মহাপশু ও অতিকায় হস্থির প্রস্তরময় বা প্রকৃত কঙ্কাল প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে, তাদৃশ্য আকার- বিশিষ্ট উল্লিখিত জাতি সকল এখন আর দেখিতে পাওয়া যায় না।
ইহার সবিশেষ বিবরণ জীব-লয় অংশে লিখিত হইবে। এক্ষনে বক্তব্য এই যে, নরজাতিও প্রথমে অতি বৃহদাকার-বিশিষ্ট ছিল। এজন্যই বোধহয় মৎস, কূর্ম্ম, বরাহ—- এই তিন অবতারের পরেই নৃসিংহ অবতারের উল্লেখ করা হইয়াছে। নৃসিংহ শব্দে অর্দ্ধনর, অর্দ্ধ সিংহ— এতাদৃশ আকার বিশিষ্ট বলিয়া যে পুরাণাঈদিতে উক্ত হইয়াছে, উহা অলঙ্কার-মায়া-জালে আচ্ছাদিত, প্রকৃতপক্ষে উহার অর্থ 'ভূরিশক্তিসম্পন্ন বৃহদাকার মনুষ্য'।
অন্যদিকে বিবেচনা করিলেও, তৎকালীন মানবগণ যে উন্নত-শরীর, দ্রঢ়িষ্ঠ-দেহ, সবলকায় ও নির্ভীক ছিলেন, তাহা প্রতীয়মান হয়। কেননা, ঐরূপ শক্তিসম্পন্ন না হইলে বিবিধ হিংস্রজন্তুর কবল হইতে আত্মরক্ষা করা, গৃহ-নির্ম্মাণে অসমর্থ, অস্ত্র-নির্ম্মাণে অশক্ত এবং জ্ঞানধর্ম্মে অনুন্নত তৎকালীন নর-নারীর পক্ষে অসাধ্য হইত।
নৃসিংহ অবতারের পরেই বামন অবতার। এই সময়ে নরগণ গৃহ-নির্ম্মাণ ও খাদ্য-লাভের উপায়-নির্দ্ধারণ পূর্ব্বক অধ্যাত্ম-তত্ত্বে মনোযোগী হইলেন, সুতরাং পূর্ব্ববৎ একমাত্র শারীরিক পরিশ্রম আর তাঁহাদিগের অবলম্বনীয় ছিল না। এজন্য অর্থাৎ শারীরিক শ্রমের অল্পতায় শরীরও ক্রমশঃ খর্ব্ব হইতে লাগিল। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, যেমন মানবদেহের খর্ব্বতা সংঘটিত হইতেছিল, তেমনই অন্যান্য বৃহদাকার ও শক্তিশালী ইতর প্রাণীগণও ক্রমশঃ খর্ব্বকায় ও অল্প শক্তিক হইতে লাগিল।
ইহার সবিশেষ বিবরণ জীব-লয় অংশে লিখিত হইবে। এক্ষনে বক্তব্য এই যে, নরজাতিও প্রথমে অতি বৃহদাকার-বিশিষ্ট ছিল। এজন্যই বোধহয় মৎস, কূর্ম্ম, বরাহ—- এই তিন অবতারের পরেই নৃসিংহ অবতারের উল্লেখ করা হইয়াছে। নৃসিংহ শব্দে অর্দ্ধনর, অর্দ্ধ সিংহ— এতাদৃশ আকার বিশিষ্ট বলিয়া যে পুরাণাঈদিতে উক্ত হইয়াছে, উহা অলঙ্কার-মায়া-জালে আচ্ছাদিত, প্রকৃতপক্ষে উহার অর্থ 'ভূরিশক্তিসম্পন্ন বৃহদাকার মনুষ্য'।
অন্যদিকে বিবেচনা করিলেও, তৎকালীন মানবগণ যে উন্নত-শরীর, দ্রঢ়িষ্ঠ-দেহ, সবলকায় ও নির্ভীক ছিলেন, তাহা প্রতীয়মান হয়। কেননা, ঐরূপ শক্তিসম্পন্ন না হইলে বিবিধ হিংস্রজন্তুর কবল হইতে আত্মরক্ষা করা, গৃহ-নির্ম্মাণে অসমর্থ, অস্ত্র-নির্ম্মাণে অশক্ত এবং জ্ঞানধর্ম্মে অনুন্নত তৎকালীন নর-নারীর পক্ষে অসাধ্য হইত।
নৃসিংহ অবতারের পরেই বামন অবতার। এই সময়ে নরগণ গৃহ-নির্ম্মাণ ও খাদ্য-লাভের উপায়-নির্দ্ধারণ পূর্ব্বক অধ্যাত্ম-তত্ত্বে মনোযোগী হইলেন, সুতরাং পূর্ব্ববৎ একমাত্র শারীরিক পরিশ্রম আর তাঁহাদিগের অবলম্বনীয় ছিল না। এজন্য অর্থাৎ শারীরিক শ্রমের অল্পতায় শরীরও ক্রমশঃ খর্ব্ব হইতে লাগিল। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, যেমন মানবদেহের খর্ব্বতা সংঘটিত হইতেছিল, তেমনই অন্যান্য বৃহদাকার ও শক্তিশালী ইতর প্রাণীগণও ক্রমশঃ খর্ব্বকায় ও অল্প শক্তিক হইতে লাগিল।
অতঃপর শাস্ত্রে যে পাঁচটি অবতারের অর্থাৎ, পরশুরাম, রামচন্দ্র, কৃষ্ণ, বুদ্ধ ও কল্কির উল্লেখ আছে, সে সকল মানবের সবিশেষ কার্য-জন্যই নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। উহাতে প্রকৃতসৃষ্টিতত্ত্ব সংক্রান্ত কোনও রহস্য নাই । কিন্তু কেহ কেহ বলেন যে পরশুরাম অবতারও প্রথমোক্ত পাঁচটি অবতারের ন্যায় গূঢ়ভাবব্যঞ্জক। কারণ, ঐ সময়েই মানবগণ শাস্ত্র-বিদ্যার ভূয়সী উন্নতির সম্পাদন করিয়াছিলেন।
পরন্তু পরশুরাম যখন ইতিহাস-খ্যাত, তখন ঐ রূপ কল্পনা না করাই সঙ্গত। বিশেষত বামন-অবতারের পূর্ব্বেই মানবগণ শস্ত্রও শাস্ত্র-বিদ্যায় সবিশেষ নৈপুণ্য লাভ করিয়াছিলেন।
পরন্তু পরশুরাম যখন ইতিহাস-খ্যাত, তখন ঐ রূপ কল্পনা না করাই সঙ্গত। বিশেষত বামন-অবতারের পূর্ব্বেই মানবগণ শস্ত্রও শাস্ত্র-বিদ্যায় সবিশেষ নৈপুণ্য লাভ করিয়াছিলেন।
— ঈশ্বর গুরুনাথ সেনগুপ্ত।

0 Comments