প্রেম কাহাকে কহে
প্রেমময়ের প্রেমরাজ্যে যত কিছু গুন আছে, তন্মধ্যে প্রেম সর্বপ্রকারে সর্বাংশে সর্বাপেক্ষা প্রধান। ভালবাসা যাহার অঙ্কুর তাহাকে প্রেম কহে। অথবা ভালবাসার উন্নত পরিণতিকে প্রেম কহে, অর্থাৎ অপরকে আত্মায় সংলগ্ন করাকে বা অপরের সুখ দুঃখাদি অবস্থাতে আপনাকে উপনীত করাকে প্রেম কহে। যে গুন থাকলে মরিয়াও বাঁচে, আত্মাতে যাহার অভাব কখনও হয় না ও হইতেও পারে না, যাহা দুঃখকেও সুখে পরিণত করে, সুতরাং যাহা সুখ-দুঃখ চায় না, লাভালাভের অপেক্ষা করে না,
কেবল অভিষ্টকে পাইবার জন্য প্রবর্ত্তিত করে, তাহাকে প্রেম কহে। যে গুণ থাকিলে ঐ গুণের ভাজনকে পাইলে প্রাণ শীতল হয়, আত্মা তৃপ্তিলাভ করে, মনে অভিনব আনন্দরসময় ভাবের উদয় হয়, হৃদয় নবভাবে কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়, ও পরমাত্মার প্রকৃত কার্য্য করা হয়; আর না পাইলে প্রাণ কিছুতেই শীতল হয় না, হৃদয় নিরস হয়, মন ভাবশূন্যপ্রায় হইয়া পড়ে, জীবাত্মার ক্লেশের ইয়ত্তা থাকে না, এবং পরমাত্মার উৎকর্ষ ও শান্তি হয় না। মূল কথা, যে গুণে ঐ পরম গুণের ভাজনের দোষ গুণে আসিয়া পড়ে, দোষ দেখিতে বাসনা হয় না, কেবল গুণই লক্ষ্য হযকথা শুনিলে প্রাণ জুড়ায়, না শুনিলে জগৎ অন্ধকারময় বোধ হয়, অভাবে জীবন্মৃত থাকিতে হয়, ভাবে সকল অশান্তি দূরে যায়, ফলতঃ ঐ গুণের প্রকৃত ভাজনের চিহ্নমাত্র না পাইলে কিছুতেই জীবিত থাকা যায় না, তাহাকে প্রেম কহে। প্রেমে সকল গুণের গুণত্ব(সংস্কার) হয়, এজন্য উহা গুনের গুরু বলিয়া কথিত হইতে পারে। যেমন কান্তিহীন দেহের কমনীয়তা কাঞ্চনযোগে বাড়ে না, সেইরূপ প্রেমসাধনাহীন আত্মার উন্নতি অন্য গুণে তত হয়না, ইহার সাধনা সর্বপ্রথমে আরম্ভ হইলেও সর্বশেষে ও শেষ হয় না,
সুতরাং ইহা অসীম কাল সাধনের ধন। সর্ব ভূমন্ডলের সকল লোকের হৃদয়েই প্রেম আছে (বা প্রেমাঙ্কুর আছে), সকলেই উহার জন্য পাগল সকলেই ঐ ধনের ভিখারি।ঐ সুধাময় রসের স্বাদ পাইলে মোহিত না হয়, এমন কেহই নাই, তথাপি উহার স্বরূপ নির্দ্দেশ করা বোধ করি কাহারও সাধ্য নহে, কেননা যাহার অন্ত পাওয়া যায় না , তাহার প্রকৃত স্বরূপ কিরূপে নির্দিষ্ট হইবে? দুঃখময় সংসারে সুখের চন্দ্র প্রেম, ভালবাসা জীবনের বন্ধন, জীবন উহাতেই উৎপন্ন উহাতেই স্থিত এবং উহার ব্যতিক্রমেই ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। বিষময় বিষের ধনে প্রেমসুধা ব্যতীত কিছুতেই শান্তি নাই।
এ ধন আঁধারে আলোক, দুঃখে অশান্তি নাশক ও বর্ধনশীল, সুখে সুখ বদ্ধক, যৌবনে বৃদ্ধত্ব ও বাদ্ধক্যে তারুণ্য সম্পাদক এবং জীবনের চিরসম্বল। এই অসীম গুণের বর্ণন, অসীম কালেও শেষ হইবার নহে। কোন মহাত্মা এ বিষয়ে যাহা বলিয়াছেন তাহা এই ভালোবাসাকে প্রেম কহে। যে সৃষ্ট আর আত্মার দর্শন আমার নিকট সততই চারু ও মনোহর, যাহাকে নিয়ত দেখিলেও দৃষ্টি তৃপ্তি বোধ করে না ।, যাহার কথা ছিল মধুময় অমৃতময় ও কর্ণকুহরে প্রবেশ করিবা মাত্রই হৃদয় নাচিতে থাকে।
যাহার গুণ ব্যাখ্যা করিয়া শেষ করিতে পারা যায় না, হৃদয় যাহাকে হৃদয়স্থ করিয়া ও সুখের অন্তিম সীমা লাভ করিতে পারে না, যাহার দোষরাশি সে কখনই ইন্দ্রিয়গোচর হয় না, দোষ বলিয়া প্রতীয়মান হয় না,অপরের মুখে নিন্দা বা কুৎসা শুনলে হৃদয় বিরক্তির উদয় হয়, যাহার সুখে সুখী ও দুঃখে দুঃখী হওয়া হওয়া যায়, যে যে পীড়িত হইলে পীড়িত ও প্রফুল্ল হইলে আমোদিত হই, যাহার অদর্শনে সমস্ত শূন্য দেখি, সুখশান্তিবিহীন হই, আমাতে আর আমি থাকি না, কি হইয়াছে, কিসের অভাব হইয়াছে, অনুভব করিতে পারি না, প্রত্যুত কেবল জীবন্মৃত হইয়া থাকি,
যাহার মঙ্গল ভিন্ন অমঙ্গল কামনা হৃদয়ে কখনই স্থান পায় না, যাহার সামান্য তাচ্ছিল্যভাব বা অনাদরে মরমে মরিয়া যাই, যাহাকে নিঃস্বার্থভাবে আমার বলিয়া অঙ্গীকার করি, জীবনসর্ব্বস্ব সমর্পণ করিয়াও যাহার কিঞ্চিৎ সাহায্য করিতে পারিলে,হৃদয় কৃতার্থ বোধ করে, যাহাকে নিজের অনন্ত দুঃখরাশির কণামাত্র জানাইয়া দুঃখিত করিতে বাসনা হয় না, আবার যাহার দর্শনে কেমন হইয়া পড়ি, কিছু বলিতে পারি না, কিছু বুঝিতে পারি না,কেবল পুতুলের মত হইয়া পড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি,তাঁহাকেই আমি ভালবাসি, তাহাকেই আমি প্রেম করি ও এরূপ ভালবাসাকেই প্রেম কহে।

0 Comments